সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫: শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা যা বলছেন
আপলোড সময় :
১৫-০৫-২০২৪ ১১:১০:৪৭ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় :
১৫-০৫-২০২৪ ১১:১০:৪৭ পূর্বাহ্ন
সংগৃহীত
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা না বাড়ানোর পক্ষে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও সাবেক সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাঁদের মতে, বয়সসীমা ৩৫ করলে তরুণরা সরকারি চাকরি পেতে আরও অতিরিক্ত সময় ব্যয় করবে। এ ছাড়া চাকরিদাতারাও অতিরিক্ত প্রার্থীর চাপে পড়বে। যদিও প্রতিবেশী দেশের উদাহরণ, গড় আয়ু বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণ দেখিয়ে ৩৫ বছর করার পক্ষে আন্দোলনে চাকরি প্রার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে গিয়ে দেখা যায়, স্নাতক শেষ হওয়ার আগেই বিসিএসের প্রস্তুতির জন্য পড়াশোনায় ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা প্রশ্নে ৩০ জনের সঙ্গে কথা বললে, ২৮ জনই না বাড়ানোর পক্ষে মত দেন।
আবার অনেকেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার পক্ষে তুলে ধরেন তাঁদের যুক্তি। তাঁরা বলছেন, সরকারি চাকরির বয়সসীমা অবশ্যই বাড়ানো উচিত। ২৮ বছর বয়সে নিয়মিত পড়ালেখার ধাপগুলো শেষ করে মাত্র দুই বছরে কীভাবে ভালো চাকরি পাওয়া যায়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সবশেষ নির্বাচন ইশতেহারেও সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার কথা উল্লেখ ছিল।
এদিকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আবদুল হালিম। তিনি বলন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা ভোর ৬টা বা তার অনেক আগে থেকেই ব্যাগ বাইরে রেখে বিসিএস পরীক্ষার জন্য লেখাপড়া করছে।
এখন যদি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সময় বাড়ানো হয়, তাহলে পাঁচ থেকে সাতটা ব্যাচ এভাবে প্রতিদিন গ্রন্থাগারে ভিড় করে বিসিএসের জন্য পড়াশুনা করবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত অন্য শিক্ষার্থীদেরও গ্রন্থাগারে পড়াশুনায় সমস্যা হতে পারে।
সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, এ মুহূর্তে বয়সসীমা না বাড়ানোই ভালো। সরকারি চাকরির পেছনে বেশি সময় না দিয়ে অন্য কিছুর জন্য মনোযোগী হওয়া জরুরি।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ালে আরও পাঁচ বছর সরকারি চাকরির পেছনে পড়ে থাকবে বৃহৎ তরুণ সমাজ।
আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের বিরোধিতা করে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, রাষ্ট্রকে আরও সহনশীল আচরণ করতে হবে।
এর আগে, সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ন্যূনতম ৩৫ বছর করতে অনুরোধ জানিয়ে জনপ্রশাসনমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেনকে চিঠি দেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। গত ১৭ এপ্রিল চিঠিটি পাঠানো হয়।
চিঠিতে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ন্যূনতম ৩৫ বছর করার দাবির বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের পাতা নম্বর ৩৩ এর শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি অনুচ্ছেদে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়ে মেধা ও দক্ষতা বিবেচনায় রেখে বাস্তবতার নিরীখে যুক্তিসংগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।’
মহিবুল হাসান চৌধুরী চিঠিতে আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের সকল পর্যায়ে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা আজ থেকে ৩৩ বছর আগে ১৯৯১ সালে ২৭ বছর থেকে ৩০ বছরে উন্নীত করা হয়, যখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩ বছর বিধায় চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা যৌক্তিক।
বাংলাদেশ বর্তমানে তার অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিশেষ ধাপ অতিক্রম করেছে। এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের যথাযথ সুফল পাওয়ার জন্য প্রধান শর্ত হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা। ভারত ও চীনসহ উন্নত বিশ্ব এই স্ট্রাটেজিই অনুসরণ করে সফল হয়েছে।’
বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে চিঠিতে বলা হয়, ‘বিশ্বের প্রায় ১৬২টি দেশে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা কমপক্ষে ৩৫ বছর, তার মধ্যে কিছু দেশে তা উন্মুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ হয়েও বিভিন্ন রাজ্যভেদে চাকরিতে আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৪৫ বছর, মালদ্বীপে ৪৫ বছর, শ্রীলঙ্কায় ৪৫ বছর, নেপালে ৩৫ বছর, আফগানিস্তানে ৩৫ বছর।
ভারতসহ বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো অনেক গবেষণা করেই চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে ন্যূনতম ৩৫ বছর করেছে। বিপুল শিক্ষিত যুবসমাজকে মানবসম্পদ হিসেবে কাজে লাগাতে পারলে সেটি হবে যুগোপযোগী ও যুগান্তকারী একটি সিদ্ধান্ত এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কয়েক ধাপ অগ্রসর হওয়া যাবে।’
এর পর গেল ৩ মে সব ধরনের চাকরির ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৩৫ ও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩৭ বছর করার আহ্বান জানায় চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সম্বনয় পরিষদ নামে একটি সংগঠন। আর এর জন্য সরকারকে ১১ মে পর্যন্ত আল্টিমেটাম দেয় তারা।
সংগঠনটির মুখপাত্র শরিফুল ইসলাম শুভ জানান, ১১ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫ বছর প্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোনো প্রজ্ঞাপন জারি না করলে সেই সমাবেশ থেকে পরবর্তী কর্মসূচি দেওয়া হবে।
এই আল্টিমেটামের পর গেল ৬ মে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত আপাতত সরকারের নেই বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন। এদিন সংসদ অধিবেশনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রফিকুল ইসলামের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।
জনপ্রশাসন মন্ত্রী বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়টি নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আরও আলাপ-আলোচনা করা হবে। তবে আপাতত বয়সসীমা বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত সরকারের নেই। আগামীতে বাড়াব কী-বাড়াবো না, বাড়ালে ভালো হবে কিনা? এটা আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। বিষয়টি আরও আলোচনা-পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতে দেখব, তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’
এদিকে ঘোষিত আল্টিমেটাম অনুযায়ী, চাকরির বয়স ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ ১১ মে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শুরু হয় বিক্ষোভ সমাবেশ। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ের জন্য শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন। এতে করে কিছু সময়ের জন্য এ এলাকায় যান চলাচল বন্ধ থাকে। তবে পরবর্তীতে পুলিশের হস্তক্ষেপে বিচ্ছিন্নভাবে যান চলাচল শুরু হয়। এ সময় পুলিশ ১০ জনকে আটক করে।
এ সময় বক্তারা বলেন, মানুষের গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে চাকরির বয়সসীমাও বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশে তা হয়নি। বিশ্বের ১৬২টি দেশে বয়সসীমা কমপক্ষে ৩৫ বছর। অনেক দেশে তা উন্মুক্ত।
তাঁরা আরও বলেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীর পড়াশোনা শেষ করতে অনেক বয়স হয়ে যায়। এরপর চাকরির প্রস্তুতি নিতে নিতেই বয়সসীমা শেষ হয়ে যায়। তাই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে বয়সসীমা বাড়ানো উচিত বলে দাবি করেন বক্তারা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Monir Hossain
কমেন্ট বক্স