ঢাকা , শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫ , ২৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |

এখনই সময় নতুন দেশ গড়ার

ভয়েস প্রতিদিন ডেস্ক
আপলোড সময় : ১৭-১০-২০২৪ ০১:০২:৪২ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ১৭-১০-২০২৪ ০১:০২:৪২ অপরাহ্ন
এখনই সময় নতুন দেশ গড়ার
মানুষ হিসেবে আমাদের প্রকৃতি অনুসন্ধিৎসু ও চিন্তাশীল। আমরা স্বাভাবিকভাবে জীবনের মানে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, প্রশ্ন তুলি এবং আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে উপলব্ধি গড়ে তুলি। কিন্তু আমাদের চারপাশের সমাজ এবং সংস্কৃতি বারবার কিছু নির্দিষ্ট বিশ্বাস ও মতবাদ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়, যা আমাদের স্বাধীন চিন্তার পথকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে আমাদের সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা স্থিমিত হয়ে যায়।

বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয় বরং একটি গ্লোবাল সংকট, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা দমিয়ে রেখে সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। এই চিন্তাধারা যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে এবং এর ফলাফলও একইরকম। মানুষকে যে চিন্তার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়, সেই সমাজে স্থবিরতা জন্ম নেয়, কারণ সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনীর পরিবেশ না থাকলে সমাজের বিকাশ থেমে যায়।

বিশ্বের সকল ধর্ম ও বিশ্বাসের অনুসারী মানুষদের প্রতিদিনই শোনা যায় তাদের ধর্মীয় নেতাদের থেকে—আলেম, প্রিস্ট, হিন্দু পুরোহিত বা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রচারিত ধর্মীয় আদর্শ ও নীতি। তারা মানুষকে সত্য এবং সঠিক পথে চালিত করার জন্য নানা রকমের উদাহরণ ও উপদেশ দেন। কিন্তু প্রশ্ন থাকে, তাদের আদর্শিক প্রচার কতটা সত্যিকারের অনুসরণের যোগ্য এবং তারা নিজেরাই কী সেই নীতিগুলো অনুসরণ করেন?

ধর্মীয় আদর্শ বারবার মানুষকে শোনানো হলেও, কেন সমাজে তার সঠিক বাস্তবায়ন হয় না? সূর্যের উদয়-অস্তের মতো প্রাকৃতিক ঘটনা বা পানির তরল অবস্থা নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই, কারণ তা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উপলব্ধ হয়। কিন্তু যখনই বিষয়টি বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল হয়—যেমন স্বর্গ-নরক, পাপ-পুণ্য বা ধর্মীয় নিয়মাবলী—মানুষ সেই বিশ্বাসগুলোকে পুরোপুরি মানতে বাধ্য হয় না। কেন? কারণ, বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি বড় ফারাক থাকে। বিশ্বাস এমন একটি জিনিস যা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না।

বেশিরভাগ সমাজে ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয় এই ধারণার ভিত্তিতে যে, ব্যক্তি স্বাধীনতা দিলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। অথচ এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। যে সমাজে মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে না, সেই সমাজে নতুন কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই। ইতিহাসের পাতা থেকে আমরা দেখতে পাই, স্বাধীন চিন্তাভাবনার অধিকারী মানুষই সমাজে বিপ্লব ও পরিবর্তনের সূচনা করেছে। স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি ব্যক্তির চিন্তা, মতামত এবং সৃজনশীলতার সীমানা।

যদি মানুষকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে দেওয়া না হয়, তবে সমাজ স্থবির হয়ে পড়ে। বর্তমান বিশ্বের অনেক সমাজে এই চিন্তা-সংকট চলছে—স্বাধীন মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা, ধর্মীয় ও সামাজিক চাপ এবং কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। এ থেকে বোঝা যায় যে, চিন্তার স্বাধীনতা না থাকলে শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো সমাজই পিছিয়ে পড়ে।

আজকের বিশ্বে ধর্মীয় বিশ্বাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন ধর্মকে ব্যক্তি ও সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। শতাব্দী ধরে ধর্ম মানুষকে নৈতিকতা ও জীবনের আদর্শ শেখাতে সাহায্য করেছে, কিন্তু যখন ধর্ম মানুষকে নতুন প্রশ্ন করতে, নতুন পথ খুঁজতে, বা স্বাধীন চিন্তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তখন ধর্মীয় মতাদর্শ স্থবির হয়ে পড়ে।

ধর্মের ক্ষেত্রে, ব্যক্তি যদি নিজে উপলব্ধি করতে না পারে, তাহলে সেই বিশ্বাসের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। যেমন, আজও আমরা ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে শুনি, কীভাবে ভালো আচরণ করতে হবে বা পুণ্য অর্জন করতে হবে, কিন্তু সেই নেতারাই হয়তো বাস্তবে সেই আদর্শ মেনে চলেন না। এই দ্বৈত আচরণই মানুষকে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে। তাই বিশ্বাসের ক্ষেত্রে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়। সত্যিকারের বিশ্বাস তখনই জন্মায়, যখন তা ব্যক্তিগত উপলব্ধির মাধ্যমে আসে।

নতুন একটি পৃথিবী গড়তে হলে, আমাদের প্রথমে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ব্যক্তি যদি স্বাধীনভাবে তার চিন্তা, উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জীবনের মানে খুঁজে বের করতে পারে, তখনই সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনীর বিকাশ ঘটবে। সমাজের ওপর চাপানো মতবাদ এবং বিশ্বাসের পরিবর্তে, মানুষের উচিত নিজের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে সমাজের উন্নয়ন ঘটানো।

আজকের বৈশ্বিক সমাজে, ব্যক্তির স্বাধীনতা না থাকলে কোনো উন্নত ও আধুনিক সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। যদি মানুষকে সত্যিকার অর্থে সৃজনশীল এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে না দেওয়া হয়, তাহলে সমাজ স্থবির থাকবে, এবং ব্যক্তির চিন্তার বন্ধন অটুট থাকবে।

আমাদের সমাজের উন্নতির জন্য প্রয়োজন নতুন দিশার, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার এবং চিন্তার স্বাধীনতা থাকবে। বিশ্বব্যাপী সমাজকে গঠন করার জন্য, প্রয়োজন মুক্ত চিন্তা, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার সংস্কৃতি। যে সমাজে স্বাধীনতা থাকবে, সেখানেই সত্যিকার উন্নয়ন ঘটবে এবং সৃষ্টিশীলতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
([email protected])

নিউজটি আপডেট করেছেন : Iqbal Hasan

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ