ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫ , ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |

বাংলার ঐতিহ্য

আদি সংস্কৃতি যাত্রাশিল্প.........

বিনোদন রিপোর্টার
আপলোড সময় : ১৮-০২-২০২৫ ০৫:৪১:১৫ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ১৮-০২-২০২৫ ০৫:৪৬:৩১ অপরাহ্ন
আদি সংস্কৃতি যাত্রাশিল্প.........
নটরাজ এন,এ পলাশঃ বাঙালি জাতির নিজস্ব কৃষ্টি কালচার, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। শিল্প, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, কালচারেও সভ্যতায় বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যমণ্ডিত। এই আদি যাত্রাপালার ঋদ্ধতার কথা বলার অপেক্ষাই রাখে না। আদি যাত্রাশিল্পঃ গ্রাম,শহর-বন্দরে যাত্রাপালাগান স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল। গত ষাটের দশকে গ্রামগঞ্জে যাত্রাপালা গানের রমরমা অবস্থা ছিল। একসময় গানের জগতে গ্রাম্যফোন গ্রামের লোকের কাছে কলের গান হিসেবে সমাদৃত ছিল। পুতুল নাচ, কবিগান, জাড়ি গান, হাড়ি গান, শাড়ি গান, ভাওয়াইয়া গান, গাজীর গান, ইত্যাদি ইত্যাদি,,, ভাসানযাত্রা, রামযাত্রা, কৃষ্ণযাত্রা, রথযাত্রা, সহ-যাত্রাপালা ইত্যাদি, গ্রাম বাংলায় কখনো হ্যাজাক লাইট কখনো হারিকেনের লাইটের আলোয় অভিনীত হতো। ছেলেরা নায়িকা ও নায়িকার সখী সাজতো। ছেলেরা মেয়ে সেজে নৃত্য পরিবেশন করতেন। জমিদার বাড়িতে দুর্গাপূজা উপলক্ষে যাত্রাগান পরিবেশন করতো সৌখিন যাত্রাদল। কয়েক হাজার শতক আগে যাত্রা ও পালাগানের উদ্ভব। যাত্রা ও পালাগানের উদ্ভবকাল ছিল সুষমমণ্ডিত। কালের যাত্রাপথে যাত্রাশিল্প আলোকউজ্জ্বল ধারায় শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গনে স্বমহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শারদীয় দুর্গাপূজা থেকে যাত্রাশিল্পের নতুন মৌসুম শুরু হতো, পূজার সপ্তমীর দিন থেকে চৈত্রের বাসন্তী পূজা পর্যন্ত এই ছয় মাসে যাত্রাদলের মৌসুম নির্ধারিত ছিল। আষাঢ় মাসের রথযাত্রা থেকে নতুন যাত্রাপালার রিহার্সালের মাধ্যমে নতুন মৌসুমের প্রস্তুতি চলতো। শ্রাবণ মাসের মধ্যে শিল্পীচুক্তির পালা সংগ্রহ, নতুন পালা নির্বাচন, নতুন সাজ সরঞ্জাম সংগ্রহ ইত্যাদি কাজ শেষ করে দলগুলো উঠে যেতো মহড়া বাড়িতে। দুই থেকে তিন মাস দিনে-রাতে সমানে অভিনয় ও নৃত্যগীতের মহড়া চলতো। তারপর পূজার বায়না নিয়ে দলগুলো ছড়িয়ে পড়তো বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জের, পূজামণ্ডপে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নদীমাতৃক এই দেশ। বর্ষাকাল থেকে শীতকাল পর্যন্ত খাল-বিল, নদী-নালা জলে ভরা থাকতো। তাই সেই সময় যাত্রাদলের অবস্থান বা প্রধান কার্যালয় ছিল একমাত্র নৌকায়। মনে হত এই বিশাল নৌকা যেন একটা গোটা বাড়ি। নৌকাগুলো এত পরিচিত ছিল, দেখেই বলা যেতো, কোন দলের কোনোটি। নৌকাতেই কাটাতে হতো বছরের সাত-আট মাস। মনে হত নৌকাটিই ছিলেন যাত্রাশিল্পীদের ঘরবাড়ি। এক গঞ্জ থেকে আরেক গঞ্জের পথে নদীপথে ছিল যাতায়াত, নৌকাতেই চলতো রিহার্সেল, গান-বাজনা। সেই ব্রিটিশ আমলে, এমনকি স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে খুব ঘটা করে উৎসবের আমেজে দুর্গাপূজায় যাত্রাগানের আসর বসতো। ব্রিটিশ শাসিত বাংলায়, ৪৭'উত্তর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে ৮০'র দশক পর্যন্ত শারদীয় দুর্গঊৎসবের প্রধান বিনোদনই ছিল একমাত্র যাত্রাগান। বিগত ৪০'দশকের দিকে মহাসমারোহে দুর্গাপূজা হতো ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা ও গৌরীপুর জমিদারবাড়িতে। দুর্গাপূজার প্রধান আকর্ষণ ছিল যাত্রাগান। সপ্তমী থেকে নবমী এই তিন দিন মন্দির প্রাঙ্গণে বসতো যাত্রার আসর। দেশীয় দলের পাশাপাশি কলকাতার দলগুলোকেও এখানে বায়না করে আনা হতো। ঢাকা শহর তখনো নগ'রায়ণে বসেনি। কারওয়ান বাজারের কাছে পালপাড়া নামে একটি গ্রাম ছিল। বারোয়ারি দুর্গাপূজা হতো প্রাণবল্লভ পালের বাড়িতে। দিনের বেলা গ্রাম্যফোন বা কলের গানে বাজানো হতো প্রবীণ অভিনেতা নির্মলেন্দু লাহিড়ীর কণ্ঠে সিরাজউদ্দৌলার রেকর্ড, কিংবা কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ মল্লিক প্রমুখের গান। রাতে বসতো যাত্রাপালার আসোর। গত ৬০'এর দশকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের রণদাপ্রসাদ সাহা বা আরপি সাহার পূজাবাড়িতে বায়না করা হতো চট্টগ্রামের বাবুল অপেরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জয়দুর্গা অপেরা, ভোলানাথ অপেরা, ঝালকাঠির নট্ট কোম্পানি এবং ময়মনসিংহের নবরঞ্জন অপেরা প্রমুখ। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের বছরে বিপ্লবী পালা, একটি পয়সা’র যাত্রাপালা প্রথম মঞ্চায়ন হয় আরপি সাহার পূজাবাড়িতে। যাত্রাদলগুলো শুধু দুর্গাপূজার জন্যই সেকালে কয়েকটি দেবী দুর্গা, মহিষাসুর বধ, ‘দক্ষযজ্ঞ, মহীয়সী কৈকেয়ী, রাবণ বধ, রামের বনবাস ও রাজা হরিশ্চন্দ্র ইত্যাদি ইত্যাদি। অভিনীত হতো বাংলাদেশের বিভিন্ন পূজামণ্ডপে যেসব যাত্রাপালা, ১৯৪২'থেকে ১৯৭০'সাল পর্যন্ত প্রথম মঞ্চায়ন হয় নট্ট কোম্পানির আকালের দেশ, বাঙালি, সত্যনারায়ণ অপেরার, গাঁয়ের মেয়ে, রঞ্জন অপেরার রাজনন্দিনী, বাসন্তী অপেরার সোহরাব-রুস্তম, বাবুল অপেরার রাহুগ্রাস, মা ও ছেলে, গীতশ্রী অপেরার লোহার জাল, জয়দুর্গা অপেরার সাধক রামপ্রসাদ, নিউ বাবুল অপেরার রাজসন্ন্যাসী ও নবরঞ্জন অপেরার বাগদত্তা। প্রতিবছর দুর্গাপূজায় যাত্রাগানের যে রমরমা আসর বসতো, কালে কালে তা পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে গেছে। সেকালের জমিদাররাও নেই, নেই টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের আরপি সাহা আর নেই ঢাকার কারওয়ান বাজারের কাছে পালপাড়া। সেকালের জয়দুর্গা অপেরা, বাবুল অপেরা, ভোলানাথ অপেরা, নট্ট কোম্পানি, নবরঞ্জন অপেরা আজ আর নেই। এখন পূজামণ্ডপ প্রাঙ্গণে ধুমধারাক্কা ডিজে গান বাজে যান্ত্রিক ইলেক্ট্রনিক বক্সে বা মাইকে। তার তালে যুবক-যুবতীরা লম্ফঝম্ফ নৃত্য করে। সেকালের যাত্রাপালা দেখার আগ্রহ তারা কোথা থেকে পাবে... বর্তমানে ঘরে ঘরে টিভি চ্যানেলে সিরিয়ালের নাটক, মোবাইলফোনের নাটক গান সহজে উপভোগ করা যাচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাহীনতা, রুচিশীল দর্শকের অভাব, যাত্রাপালায় অশ্লীলতার কারণে বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রা ও পালাগানের অবক্ষয় নেমে এসেছে। বাংলার যাত্রাশিল্প ইতিবৃত্ত জানতে হলে আমাদের অবশ্যই অতীতে ফিরে যেতে হয়। বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) অনুভব করেছিলেন, বক্তৃতা করে বাংলার মানুষকে যা বোঝানো যাবে না, একবার যাত্রাভিনয় করে তা মানুষের মনে খুব সহজেই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। সাড়ে চার শ’ বছর আগে শ্রীগৌরাঙ্গ, যাত্রাশিল্পকে গৌরবান্বিত করেছিলেন তা দেখতে হলে তার ইতিহাস তুলে ধরা প্রয়োজন। শ্রীগৌরাঙ্গের বয়স মাত্র ১৪'বছর, সে সময় বডু-চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেন, সময়টা ছিল সম্ভবত ১৫০০'সালের দিকে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের প্রভাবে শ্রীগৌরাঙ্গ তার গীতাভিনয়ে নিজস্ব অভিনয়পদ্ধতি সৃষ্টি করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও তিনি সংস্কৃত নাটকের ধ্রুপদ অভিনয়-পদ্ধতি গ্রহণ করেননি। চারদিকে দর্শক-শ্রোতা, মাঝখানে আসরে নৃত্য, গীত ও কথার মাধ্যমে তিনি ব্রজলীলা, রাবণবধ প্রভৃতি যাত্রাপালা পরিবেশন করেছেন। শোভাযাত্রা তিনি তার সহচরদের নিয়ে নেচে-গেয়ে কৃষ্ণলীলা প্রদর্শন করেছিলেন। অনেকের মতেই, যাত্রাগানের বিকাশ শুরু হয় ১৮'শতকের মাঝামাঝি সময়ে, যাত্রাপালার উৎপত্তি থিয়েটার বা নাটকের অনেক আগে থেকেই। নাটকের আগেই যাত্রার বিকাশ ঘটে। এ কারণে যাত্রার ঐতিহ্যকে প্রথমেই তুলে ধরতে হয়। যাত্রাশিল্প সুকুমারকলার মর্যাদায় অভিষিক্ত ছিল। ষোড়শ শতকে শ্রীগৌরাঙ্গের প্রভাবে জন্ম নেওয়া কৃষ্ণযাত্রাই অধিকতর স্থায়ী এবং জনপ্রিয় হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের কেঁদুলি গ্রামের অধিবাসী শিশুরাম অধিকারী ১৮'শতকের মাঝামাঝি সময়ে কৃষ্ণযাত্রাকে শিল্পসম্মতভাবে পরিবেশন করে সু'খ্যাত হন। তিনি ‘কালীয়দমনযাত্রা’র প্রবর্তন করেন, যা পরিবর্তীকালে ‘কৃষ্ণযাত্রা’ নামে জনপ্রিয় হয়। কৃষ্ণযাত্রার পালাগুলোর মধ্যে কলঙ্কভঞ্জন, মানভঞ্জন, নৌকাবিহার, গোষ্ঠবিহার সুবলমিলন, যোগীমিলন, প্রভাসমিলন, মুক্তলতাবলী, কৃষ্ণকালী, ননীচুরি প্রভৃতি যাত্রাপালাগুলি ছিল উল্লেখযোগ্য। এই পালাগুলো বিশেষভাবে দর্শকনন্দিত হয়েছিল। প্রসঙ্গত, ১৮'শতকের শেষভাগে ভরতচন্দ্র রায় গুণাকরের (১৭১২-১৭৬০) ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের কাহিনি অবলম্বনে রচিত বিদ্যাসুন্দর যাত্রাপালা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ওই সময় গ্রামের অশিক্ষিত আর অল্পশিক্ষিতদের পক্ষে ইংরেজদের প্রচলিত থিয়েটারের প্রতি আসক্তি ছিল না নানা কারণে। গ্রামগঞ্জে থিয়েটার করা ব্যয়সাধ্য ছিল। রাস্তাঘাট ছিল না, ছিল না পয়সাকড়ি, ছিল না থিয়েটারের কাহিনি বোঝার ক্ষমতা। এ কারণেই কৃষ্ণযাত্রা ও রামযাত্রা ইত্যাদি দেখার আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে সাধারণ জনগণের মাঝে। সেটা ছিল আঠারো উনিশ শতকের মাঝামাঝি। থিয়েটারের হাত থেকে যাত্রার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসেন সে সময়ের যাত্রার অন্যতম অধিকারী কৃষ্ণকমল গোস্বামীসহ অনেকেই। কৃষ্ণকমল গোস্বামী ১৮৬০'সালে তার রচিত স্বপ্নবিলাস ও দিব্যোন্মাদ পালার মাধ্যমে যাত্রাশিল্পে প্রাণ সঞ্চার করেন। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তার পালাগুলো পরিবেশন করে প্রশংসা লাভ করেন। ক্রমবিবর্তনের ধারায় শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিক্রম করে তৎকালীন বাংলার ঢাকাতে প্রথম যাত্রাপালা সম্ভবত সীতার বনবাস। সীতার বনবাস-এর কাহিনিকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তারপর একরামপুর থেকে স্বপ্নবিলাস নামে একটি যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হয়, যা শহরে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। স্বপ্নবিলাস-এর সাফল্যের পর একরামপুর থেকে পরপর মঞ্চস্থ হয় রাই-উন্মাদিনী ও বিচিত্রবিলাস। নবাবপুরের বাবুদের তখন বেশ নামডাক। সময়টা ছিল ১৮৬০'সাল থেকে ১৮৭৫'সালের মধ্যে। ঢাকার সৌখিন যাত্রাদলের যাত্রাপালার নাম ছিল কোকিল সংবাদ। শহরে ছয়মাস ও গ্রামাঞ্চলে প্রায় একবছর ধরে কোকিল সংবাদ যাত্রাপালাটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। ঊনিশ শতকের শেষভাগে নওয়াবপুরের বসাক সম্প্রদায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস অবলম্বনে একটি যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করেছিলেন। এ দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে একরামপুরের অধিবাসীরা কৃষ্ণকমল গোস্বামী রচিত স্বপ্নবিলাস যাত্রাপালা অভিনয় করেন। এই যাত্রাপালা পরপর ছয় রাত্রি মঞ্চস্থ হয়। এই ঢেউ এবার গ্রামাঞ্চলেও গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। নারায়ণগঞ্জ মহকুমার মোগরাপাড়ার যা ছিল প্রাচীন সোনারগাঁ’র অন্তর্গত, সৌখিন ব্যবসায়ীদের আর্থিক সাহায্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় পরপর দুই রাত স্বপ্নবিলাস-এর অভিনয় হয়েছিল। ঢাকার বাইরেও যাত্রা অভিনয় ব্যাপকতা লাভ করে। তবে বাংলাদেশে সম্ভবত প্রথম যাত্রাভিনয় অনুষ্ঠিত হয় বরিশালে। দুর্গাদাস কর রচিত স্বর্ণশৃঙ্খল বইটি প্রকাশ করেন। বৃন্দাবনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একে নিয়ে যাত্রাপালা করেন। এ পালায় রাজকুমার দত্ত ছিলেন এর একজন প্রধান অভিনেতা। এখন আমরা চোখ রাখতে পারি, গ্রামগঞ্জের যাত্রদলের দিকে, ১৮৭০'সালের দিকে সম্ভবত হাতেগোনা দু’তিনটি যাত্রাদল ছিল। বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার খোকসায় একটি যাত্রাদল, যা মহেশ ঠাকুরের দল নামেই পরিচিত ছিল। পরে জানিপুরের গোপী মাস্টারের যাত্রাদলও বিভিন্ন স্থানে অভিনয় করে সুনাম অর্জন করে। কলকাতায় সাধারণ থিয়েটার হল প্রতিষ্ঠার পরেই শিলাইদহে যাত্রারদল নাট্যালয়ে রূপান্তরিত হয়ে প্রহাদ চরিত্র অভিনীত হলেও গোপীনাথ দেবের রাস ও দোলযাত্রায় প্রতি বৎসর গোপীনাথ-প্রাঙ্গণে শশী অধিকারী, মথুর সা প্রমুখের যাত্রাপালা, মুকুন্দদাসের স্বদেশিযাত্রা হতো। স্থানীয় লোকেরা থিয়েটারের চেয়ে যাত্রার প্রতি আকৃষ্ট ছিল তুলনামূলক অনেক বেশি। তার প্রমাণ মেলে উনিশ শতকের শেষভাগে বরিশাল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও যশোর অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যাত্রাদল গড়ে ওঠায়। বরিশালের চারণ কবি মুকুন্দদাস, প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রফেশনাল যাত্রাদল গঠন করেন। ১৯০৫'সাল বঙ্গভঙ্গ হয়। ১৯০৫'সাল বাংলার ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বছর। সে বছর বাংলা ভাগ হয়। তখন সারা দেশে উত্তাল হয় বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন। বরিশালে অশ্বিনীকুমার দত্তের নেতৃত্বে ‘স্বদেশবান্ধব সমিতি’ বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। বরিশালের ‘স্বদেশবান্ধব সমিতি’-র সভাপতি অশ্বিনীকুমার দত্তের আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুকুন্দ দাস, সে বছরেই মাতৃপূজা নামে অভিনব এক যাত্রাপালা রচনা করেন এবং নিজে দল গঠন করে গ্রামে, শহরে গান করে বেড়াতে থাকেন। তার এই দল ‘স্বদেশী যাত্রাপার্টি’ নামে খ্যাতি অর্জন করে। মাতৃপূজা ছাড়াও তিনি কর্মক্ষেত্র, পল্লীসেবা, সমাজ প্রভৃতি পালার মাধ্যমে স্বদেশি বক্তব্য প্রচার করে ব্রিটিশ সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তার পালাগুলো নিষিদ্ধ করে তাকে কারারুদ্ধ করেন..? ঢাকার বাইরেও ঐ যাত্রাপালার অভিনয় ব্যাপকতা লাভ করেন। মুকুন্দ দাসের যাত্রাদলের অভূতপূর্ব সাফল্যে উদ্দীপ্ত হয়ে ঝালকাঠিতে ১৯০৬'সালে জন্ম হয় ‘নাগ-দত্ত-সিংহ-রায় কোম্পানি’র। এ দলে মুকুন্দ দাসের পালা ছাড়াও অহিভূষণ ভট্টাচার্যের ‘সুরথ উদ্ধার’, ভোলানাথ ১৯০৭'সালে ‘আদি ভোলানাথ অপেরা’ গঠন করেন। ঢাকায় ‘অভয়বাবু’ নামের এক যাত্রামোদী একটি যাত্রাদল গঠন করেন ১৯১০'সালে। এই দল ‘অভয়বাবুর দল’ নামে পরিচিতি পায়। এ সময় নোয়াখালীতে ‘কেষ্ট সাহার দলও খুব জনপ্রিয় হয়। যশোরের নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের যাত্রাদল ‘নীলমাধবের দল’ নামে খ্যাতি অর্জন করে। ১৯৩১'সালে ফরিদপুরের নবদ্বীপচন্দ্র সাহা ‘শঙ্কর অপেরা পার্টি’ এবং ‘নবদ্বীপচন্দ্র সাহা যাত্রাপার্টি’ নামে দুটি যাত্রাদল গঠন করেন। ‘নবদ্বীপচন্দ্র সাহা যাত্রাপার্টি’তে অভিনয় করে সেকালে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিলেন, সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তার জন্ম ১৮৮৪'সালে ফরিদপুরের লোনসিংহ গ্রামে। ১৯২৩'সালে তিনি যাত্রাশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের জয়লক্ষ্মী পালায় ‘বলাদিত্য’ চরিত্রে অভিনয়ের কারণে তিনি সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ১৯৩৪'সালে ফরিদপুরের সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় 'আনন্দ অপেরা প্রতিষ্ঠান' নামে একটি যাত্রাদল গঠন করেন। তার ভাইপো পরেশনাথ মুখোপাধ্যায় দলের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিন্ধ্যাবলী, লক্ষ বলি, আদিসূর, দাক্ষিণাত্য, তর্পণ, বঙ্গে বর্গী, রাখিবন্ধন, ছগনলাল, সপ্ত'মাবতার প্রভৃতি ছিল এই দলের জনপ্রিয় পালা। প্রত্যেক পালায় অভিনয় করতেন সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি নব্যধারার অভিনয়কে প্রতিষ্ঠা দিয়ে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার স্বীকৃতি পান। এবং নটসম্রাটে ভূষিত হন। সে সময় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথধামে শিবচতুর্দশী মেলায় যাত্রপালা অভিনীত হতো। হবিগঞ্জের "হারুন অপেরা" নামে একটি, মালিক ছিলেন জনাব আনোয়ার উদ্দিন খাঁন, ১৯৭৪'সালে, প্রতিষ্ঠা করা হয়, এই দলে অভিনয় শিল্পীরা সুনামের সাথে অভিনয় করতে দেখেছি, মরণ নন্দী, ভাষান নন্দী,ব্রজেন নন্দী, কানু নন্দী, দেবদাস, নয়ন মিয়া, শওকত মিয়া, ননী চক্রবর্তী প্রমুখ। ১৯৩৭-৩৮'সালে যাত্রা কলকাতার ভুটুয়া বালক সম্প্রদায়, রঞ্জন অপেরা, অর্ঘ্য অপেরা, ফরিদপুরের নড়িয়ার আদি ভোলানাথ অপেরা, ঢাকার নারায়ণগঞ্জের মথুর সাহা, নবদ্বীপ সাহার যাত্রাদল, বরিশালের নট্ট কোম্পানি প্রভৃতি পেশাদার যাত্রাদল আসর জমাতো মেলায়। সে সময় যাত্রাপালা ছিল বাজীরাও, শিবাজী, রূপসাধনা, বাংলার ছেলে, মায়াশক্তি, মান্ধাতা শুক্রাচার্য ইত্যাদি। অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ, কালীদমন গুহঠাকুর, সুরেশ মুখার্জী, মতিলাল, ফণি গাঙ্গুলি, নলিনী দাস, গণেশ গোস্বামী, ক্ষেত্র চ্যাটার্জী, গুরুপদ ঘোষ, সুনীল মুখার্জী,পঞ্চু সেন প্রমুখ। নারীচরিত্রে রূপদানকারীদের তখন রানী বলা হতো। সেই রানীদের মধ্যে রেবতী রানী, হরিপদ বায়েন, নিতাই রানী, সুদর্শনরানী, সুধীররানী, ছবিরানী প্রমুখ রানী সেজে অভিনয় করতেন। তবে ১৯১৫'সালে মহিলা পরিচালিত প্রথম যাত্রাদল ‘লেডি কোম্পানি’ ঝালকাঠিতে গঠিত হয়। এর অধিকারী ছিলেন শ্রীমতী বোঁচা নামের এক নারী। এটাই ছিল প্রথম মেয়েদের প্রথম যাত্রাদলে অংশগ্রহণ, তার আগে ছেলেরাই মেয়ে সাজতো। মানিকগঞ্জের কার্তিকচন্দ্র সাহা ১৯৪৪'সালে গঠন করেন ‘অন্নপূর্ণা যাত্রাপার্টি’। এ সময়ে দৌলতপুর থানার বিনোদপুরে ‘কানাই-বলাই অপেরা পার্টি’ নামের একটি সখের দল ছিল। তখনকার খ্যাতিমান যাত্রাশিল্পীদের মধ্যে সুধীররঞ্জন বসু রায়, গৌরগোপাল গোস্বামী, নীতীশচন্দ্র অধিকারী, আকালী হালদার প্রমুখ। প্রসঙ্গত, বলতে হয়, ১৯৪৭'সালে গঠিত যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী’র ‘জয়দুর্গা অপেরা’তে নৃত্যশিল্পী জ্যোৎস্নারানী দত্তের মাধ্যমে ছেলেদের মেয়ে সাজিয়ে অভিনয়রীতির ব্যতিক্রম ঘটে। কৌতুকাভিনেতা সূর্য দত্ত ছিলেন তার পিতা। সূর্য দত্তের আরো তিন মেয়ে মায়ারানী দত্ত, ছায়ারানী দত্ত, দয়ারানী দত্ত জয়দুর্গা অপেরাতে নাচগান ও অভিনয় করে মেয়েদের যাত্রাশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘জয়দুর্গা অপেরা’ খুবই আলোচিত ও নন্দিত হয়। উল্লেখ্য, দেশভাগের পূর্বে প্রফেশনাল যাত্রাপার্টি ছাড়া সৌখিন যাত্রাদলে নারীরা অভিনয় করতো না। তখন শৈলেনবাবু শৈলরানী নামে, সুধাময়বাবু সুধাময়ী নামে বিনোদবাবুর নারীচরিত্রে অভিনয় করতেন। উজ্জল ও সেলিমের মতো বয়োঃসন্ধিক্ষণের সুদর্শন ছেলেরা ড্যান্সার হিসেবে যাত্রার প্রথম দৃশ্যের কনসার্টে অংশ নিতো। ভদ্রঘরের মেয়েরা নাটক বা যাত্রায় উৎসাহী হয়নি। বিখ্যাত যাত্রাদল ‘নট্টকোম্পানি যাত্রাদল’ ১৯২৪'সালে ঝালকাঠির বৈকুণ্ঠনাথ নট্টের হাতে জন্ম নেওয়া ‘নট্টকোম্পানি যাত্রাপার্টি’ দুই বাংলায় জনপ্রিয় যাত্রাদল ছিল ব্রিটিশ আমলে। মুসলিম পরিচালিত প্রথম যাত্রাদল হলো ‘মুসলিম যাত্রাপার্টি’। ১৯৩০'সালের পটুয়াখালীর মোজাহের আলী সিকদার চালু করেন ‘মুসলিম যাত্রাপার্টি’। মোজাহের আলী সিকদার ১৯৬৬'সালে ‘বাবুল যাত্রাপার্টি’ নামের আরেকটি যাত্রাদল গঠন করেন। এক সময় ‘বাবুল যাত্রাপার্টি’ বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। এখানে উল্লেখ করতে হয় পাঠক ‘বাবুল যাত্রাপার্টি’ ও ‘বাবুল অপেরা’ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন, তাই ‘বাবুল অপেরা’ সম্বন্ধে একটু জেনে রাখুন, স্বনামধন্য ‘বাবুল অপেরা’ ১৯৫৮'সালে গঠিত হয়। ‘বাবুল অপেরা’র অধিকারী ছিলেন চট্টগ্রামের আমিন শরীফ চৌধুরী। ১৯৬০'সাল থেকে এ দলে নারীশিল্পীরা অভিনয় করতে শুরু করে। এ সময়ে পরিচালক ছিলেন জনাব অমলেন্দু বিশ্বাস। নারীশিল্পী জ্যোৎস্না বিশ্বাস ও জয়শ্রী প্রামাণিক ছাড়া এ দলে পুরুষশিল্পী ছিলেন তুষার দাশগুপ্ত, ঠাকুরদাস ঘোষ, কালী দত্ত, ফণীভূষণ, অমিয় সরকার, স্বারক হিসেবে প্রথম অভিষেক ঘটে জনাব মিলন কান্তি দে প্রমুখ। বাবুল অপেরায় অন্য উদ্যোক্তারা ছিলেন সাদেকুন নবী, মলয় ঘোষ দস্তিদার, রুনু বিশ্বাস প্রমুখ। প্রখ্যাত নট অমলেন্দু বিশ্বাস ছাড়াও এ দলের শুরুতে শিল্পী হিসেবে ছিলেন সাদেক আলী, নাজির আহমেদ, সাধনা চৌধুরী, মঞ্জুশ্রী মুখার্জী, বেণী চক্রবর্তী, ঊষা দাশ, মকবুল আহমেদ, এম,এ হামিদ, জাহানারা বেগম, শান্তি দেবী প্রমুখ। জাহানারা বেগম এ দেশের প্রথম মুসলিম নারীশিল্পী। অমলেন্দু বিশ্বাস জানিয়েছেন, ‘বাবুল অপেরা এ দেশে নারী-পুরুষ সমন্বয়ে যাত্রাভিনয় প্রথার প্রচলন করে নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেয়’। এ সাহসী নারীশিল্পীদের অন্যতম মঞ্জুশ্রী মুখার্জীর জন্ম চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের বাবুল থিয়েটারে ১৯৫০'সাল থেকে অভিনয় শুরু করেন। ‘বাবুল অপেরায়' মঞ্জুশ্রী মুখার্জী এ দলের নায়িকা হন। এর আগে কোনো নারী নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেননি। বাবুল অপেরাই প্রথম নারী-পুরুষ সম্মিলিত যাত্রাদল। অমলেন্দু বিশ্বাস এই প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী সম্পর্কে বলেছেন, ‘একটানা চৌত্রিশ বছর নৃত্যগীতপটীয়সী যাত্রানায়িকা মঞ্জুশ্রী মুখার্জী চট্টগ্রামের ভ্রাম্যমাণ যাত্রাদল বাবুল অপেরার যাত্রামঞ্চে এ দেশের লক্ষ লক্ষ যাত্রারসিকের মন বিচিত্র নাট্যভাবনার রঙে-রসে আপ্লুত করেছেন’। বাবুল অপেরার মঞ্জুশ্রী মুখার্জীর অনবদ্য অভিনয় দেখার সুযোগ ঘটেছিল ষাটের দশকে যশোর টাউন হল ও শ্রীপুর পাইলট স্কুলের প্রাঙ্গণ, তবে তখন কোনো প্রকার অশ্লীলতার নাম গন্ধ ছিল না, যা আজকের দিনে কল্পনা করা যায় না..? বাবুল অপেরার পরে নারীশিল্পী সংযোজনের দিক থেকে দ্বিতীয় দল ‘বাসন্তী মুক্তমঞ্চ নাট্যপ্রতিষ্ঠান’। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ফকিরহাট গ্রামের তুষার দাশগুপ্ত খ্যাতিমান অভিনেতা, ১৯৫৪'সালে জয়দুর্গা অপেরায় যোগ দেন। এরপর তিনি গোকুলেশ্বরী অপেরা নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৫৭'সালে যান বাবুল অপেরায়। ১৯৬০'সালে অমলেন্দু বিশ্বাসের সহযোগিতায় তিনি বাসন্তী মুক্তমঞ্চ নাট্যপ্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। পরে 'সৎসঙ্গ অপেরা' নামে একটি দল তিনি গঠন করেন। তবে নিজের করা দুটি দলই সফল হয়নি। ১৯৭০'সালে 'গীতশ্রী অপেরায়' কাজ করার সময়ে নবাগতা নায়িকা রীনা রাণীকে বিয়ে করেন। এ রীনা রাণীই পরবর্তীকালের জনপ্রিয় যাত্রানায়িকা শবরী দাশগুপ্ত। ১৯৭৪'সালে তিনি নিজের নামে 'তুষার অপেরা' গঠন করেন। এ দল তাকে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। তিনি যাত্রামঞ্চে আধুনিক উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। দেশীয় পালা মঞ্চায়নের ব্যাপারে তিনি উদ্যোগী ছিলেন। পালাকার পরিতোষ ব্রহ্মচারী রচিত পালা ক্লিওপেট্রা, দস্যুরানী ফুলন দেবী এবং রূপান্তরিত পালা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিরাজ বৌ অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেন। তুষার দাশগুপ্তের স্ত্রী শবরী দাশগুপ্তার জন্ম যশোরে। ১৯৭৯'সালে, তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় যাত্রা উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। ক্লিওপেট্রা, দস্যুরানী ফুলন দেবী প্রভৃতি পালায় তিনি স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘জয়দুর্গা অপেরা’র ম্যানেজার গোপালকৃষ্ণ পরে ১৯৬০'সালে ‘ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরা’ এবং ১৯৬২'সালে ‘রয়েল ভোলানাথ অপেরা’ গঠন করেন। গোপালকৃষ্ণের আদিনিবাস উড়িষ্যায়। তিনি বাংলাদেশের যাত্রাশিল্পের সমৃদ্ধি ঘটান। ময়মনসিংহের আবদুল হামিদ ১৯৬৬'সালে গঠন করেন ‘নবরঞ্জন অপেরা’। ১৯৬৭'সালে গঠিত ‘গীতশ্রী যাত্রা ইউনিটে’র অধিকারী ছিলেন চট্টগ্রামের গোপালচন্দ্র রুদ্র। ময়মনসিংহের আবদুল খালেক ভুঁইয়া একই বছর গঠন করেন ‘বুলবুল অপেরা’। পরের বছর- ১৯৬৮'সালে ফরিদপুরের স্বপনকুমার সাহা ‘নিউ বাসন্তী অপেরা’ চালু করেন। যাত্রাশিল্পের ক্ষেত্রে ‘দীপালি অপেরা’র অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ১৯৬৯'সালে গোপালগঞ্জের ধীরেন্দ্রকুমার বাকচী ‘দীপালি অপেরা’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৭২'সালে ‘আদি দীপালি অপেরা’ এবং ১৯৭২'সালে ধীরেন্দ্রকুমার বাকচী ও তার স্ত্রী বনশ্রী বাকচীর সঙ্গে যৌথ মালিকানায় ‘১ নং দীপালি অপেরা’ গঠন করেন। তিনি এ সময়ে ‘নব দীপালি অপেরা’ এবং ‘দীপ দীপালি অপেরা’ নামে আরো দুটি যাত্রাদল প্রতিষ্ঠা করেন। একই সঙ্গে পাঁচটি দলের অধিকারী হওয়া নিঃসন্দেহে যাত্রাশিল্পের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বনশ্রী বাকচীর একজন নিপুণ ও পরিশীলিত অভিনেত্রী । অভিনয়ের সঙ্গে বনশ্রীর সুরেলা কণ্ঠের গানে লক্ষ লক্ষ মানুষ মুগ্ধ। এ সব বিখ্যাত যাত্রদলগুলোর অস্তিত্ব আজ আর নেই। ১৯৭০'সালে বাগেরহাটের পরিমল হালদার প্রতিষ্ঠা করেন ‘জয়শ্রী অপেরা’। ‘নিউ গণেশ অপেরা’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২'সালে। এর অধিকারী মানিকগঞ্জের গণেশচন্দ্র ঘোষ। হবিগঞ্জের লিপাই মিয়া একই বছরে গঠন করেন ‘কোহিনুর অপেরা’। ময়মনসিংহে ঐতিহ্যবাহী দল ‘সবুজ অপেরা’ গঠিত হয় ১৯৭২'সালে। প্রথম অধিকারী নুরুল ইসলাম হলেও পরে দেলোয়ার হোসেন বাচ্চু এ দলটিকে জনপ্রিয় করেন। ১৯৭২'সালে নড়াইলের শেখ খলিলুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন ‘রঙমহল অপেরা’। দলটি স্বাধীনতার পরে বেশ সক্রিয় ছিল। নওগাঁর খগেন লস্কর একই বছর গঠন করেন ‘রূপশ্রী অপেরা’। মানিকগঞ্জের ডা. ব্রজেন্দ্রকুমারের ‘জগন্নাথ অপেরা’ ও ভানু সাহার ‘অম্বিকা যাত্রাপার্টি’ রমরমা ছিল। যখন থেকে যাত্রাশিল্পের কর্নধার যাত্রাশিল্পের মানুষ না হয়। তখন থেকেই যাত্রাশিল্পের অশ্লীলতার শুরু......... নটরাজ এন এ পলাশ সভাপতি বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন সোসাইটি কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ঢাকা। ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SM Sohel

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ