ওষুধের মূল্য নির্ধারণে চরম নৈরাজ্য চলছে অব্যাহতভাবে। ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে অনেক কোম্পানি। দুই মাসে দেশের বিভিন্ন কোম্পানি তাদের উৎপাদিত ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বাড়িয়েছে। ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে অদৃশ্য কালো হাত। অন্তত ৫০ ধরনের ওষুধের দাম ২০ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
গত মার্চ মাসে দাম বাড়ানো হয়েছে বেশ কয়েকটি ওষুধের। সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট, ডায়াবেটিসের রোগীদের ইনসুলিন ও ইনজেকশনের দাম। এছাড়া হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, হাঁপানিসহ বিভিন্ন ওষুধ এবং ভিটামিনের দামও বেড়েছে। বাদ যায়নি জ্বর-সর্দির ট্যাবলেট-ক্যাপসুল, বিভিন্ন অসুখের সিরাপও। একদিকে দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে ওষুধের গুণগত মান কমছে। নকল ও ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব। তদারকির নামে চলছে অর্থ বাণিজ্য। সব দিক দিয়ে ঠকছে ক্রেতারা। দেশে ক্রেতা ঠকানোর দুঃসহ চিত্রও বিদ্যমান।
ক্যান্সারের ওষুধের দাম বিদেশের চেয়ে বেশি। এক বা একাধিক কোম্পানি ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদন করে। তবে দোকানদাররা বলেন, একটি কোম্পানির ওষুধ পাই। প্রচুর দাম। এ কারণে চোরাই পথে এটি আসছে। চোরাই পথে অনেক ওষুধ আছে, কারণ ডাক্তাররা লেখেন। বাংলাদেশের ওষুধে কাজ হয় না।
চোরাই পথের ওই ওষুধে দ্রুত কাজ করে। এ কারণে ডাক্তাররা লেখেন। আবার এক শ্রেণীর ডাক্তার উৎপাদিত অনেক কোম্পানির নিম্নমানের ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লেখেন, কারণ তারা নিয়মিত উপঢৌকন দেয়, ডলার পায়, গিফট পায়। বিদেশ সফরে যাওয়ার সুযোগ পায়। অনেকের গাড়ি কিনে দেয়। অনেকের বাসা ভাড়াও দেয়। বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং বিক্রি থেকে আয়ের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দাম বাড়ানোর হার অস্বাভাবিক। এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে কোম্পানিগুলো ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছে।
এ সময় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিও উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন ওষুধ কোম্পানিগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। তারা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে ওষুধের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কারণে ওষুধের দাম কিছুটা বাড়িয়ে সমন্বয় করা হয়েছে।
রাজধানীসহ সারাদেশের মাঠ পর্যায় ওষুধের দোকানদাররা বলেন, কোম্পানি প্রতি মাসে অধিকাংশ ওষুধের দাম বাড়ায়। সরকার বছরে একবার কিংবা দুইবার বাড়ায়। ক্রেতাদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় গিয়ে মার খাওয়ার উপক্রম।
যারা নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছে, তারা বাড়তি দাম দিতে গিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করেন। প্রতিদিনই ঝগড়া হয়। রাজধানীর মিটফোর্ট এলাকা ওষুধের বৃহত্তম মার্কেট। এটি মেড ইন জিনজিরা নামে পরিচিত। অর্থাৎ নকল ও ভেজাল ওষুধে ছড়াছড়ি। বিদেশী ওষুধও নকল বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক কোম্পানির ওষুধও নকল করে বিক্রি করছে। মাঠ পর্যায়ে ওষুধ প্রশাসনের এক শ্রেণীর এলাকাভিত্তিক পরিদর্শক প্রতি মাসে ওষুধের দোকান থেকে মাসোহারা নিয়ে থাকেন। সেই টাকার ভাগ উপর পর্যন্ত যায়। প্রতি মাসে টাকা কালেকশনে কোন অজুহাত দেখানো হয় না।
মাসে লাখ লাখ টাকা ইনকাম করছে ওই সকল পরিদর্শকরা। যে ওষুধে ৫০০ এমজি থাকার কথা, পরীক্ষাগারে ধরা পড়ে ২০০ কিংবা ২৫০ এমজি। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে দিয়েছে ৫০০ এমজি, কিন্তু আছে ২০০ এমজি। তাহলে রোগ প্রতিরোধে কাজ হবে না-এটাই স্বাভাবিক। রোগ না সারায় অনেক রোগী বারবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমিরেটস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা রোগীদের ওষুধ দেই। কিন্তু রোগীর কাজ হয় না। রোগী এসে বলে রোগ ভালো হয় না। তখন আবার ওষুধ চেঞ্জ করে দেই, তারপরও কাজ হয় না। এই বিষয়টিকে নজর দিতে হবে। কারণ ভেজাল ওষুধ ঢুকে গেছে বাজারে। চোরাই পথে আসছে ওষুধ। কোনটা আসল ও কোনটা নকল ওষুধ বোঝার উপায় নেই। জীবনরক্ষাকারী ওষুধ নকল হলে, রক্ষার পরিবর্তে ওষুধ জীবন কেড়ে নিচ্ছে।
অজ্ঞান করার ওষুধ হ্যালোথিন ইতিমধ্যে নকল প্রমাণিত হয়েছে। তাই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ নকল ও ভেজাল ওষুধে অঙ্গহানী হওয়ার আশংকা থাকে। লিভার, কিডনিসহ নানা শারীরিক সমস্যা হতে পারে। অসংক্রমক ব্যাধির সংখ্যা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধির অন্যতম কারণ নকল ও ভেজাল ওষুধ বলে চিকিৎসকরা অভিমত ব্যক্ত করেছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স এন্ড হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেন, যখন সরকারি হাসপাতালে ওষুধ কেনার জন্য টেন্ডার দেওয়া হয়, তখন ১৫০ টাকার ওষুধ ৭০ টাকায় সরবরাহ করে। যে ওষুধ বাজারে বিক্রি করছে ১৫০ টাকা। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে দিচ্ছে ৭০ টাকায়। তাহলে ওষুধে গুণগত মান ঠিক আছে? গুগগত মান নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। ওষুধের বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত।
বিদেশে ওষুধ ও খাদ্যে ভেজাল কোন অবস্থাতেই মেনে নেয় না। কঠোর হাতে দমন করা হয়। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু বাংলাদেশ চলে উল্টো। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মতে, দেশে ওষুধ কোম্পানি আছে ২৮৭টি। উৎপাদন করে প্রায় ২০০ কোম্পানি।
কিন্তু পরিচিত ২০টা কোম্পানি। বাকিরা কি ওষুধ তৈরি করে, কেউ জানে না। ঢাকার ওষুধের সাথে বিভাগীয় ও গ্রামের ওষুধের মিল নেই। গ্রামে অধিকাংশ ফার্মেসির নিবন্ধন নেই। সেখানে বেশি নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রি হয়। দেশে উৎপাদিত ওষুধগুলোর জেনেরিক নাম হলো ১৬৫০টা।
তবে কমার্শিয়াল নামে আছে ৩৬ হাজার। আবার বাংলাদেশের ওষুধ বিদেশে বিক্রি হয়। সেখানে সুনামের সাথে বিক্রি করে আসছে। কিন্তু ২০টা কোম্পানি ছাড়া বাকি কোম্পানিগুলোর ওষুধের অধিকাংশ নকল ও ভেজাল। কোম্পানির নামে নকল করে বিক্রি করে। এটা দেখার যেন কেউ নেই।
এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক সালাউদ্দিন বলেন, আমরা নিয়ন্ত্রণে যা যা দরকার তা করে যাচ্ছি। মূল্য নির্ধারণের কমিটি আছে। এর মধ্যে কমিটির মিটিং হয়নি। মাঠ পর্যায়ে যারা আছে তদারকি করে। নকল ও ভেজাল ওষুধ উদ্ধার অভিযান অব্যাহত আছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, নকল, ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ, নিবন্ধনহীন ওষুধ এবং সুরক্ষা সামগ্রীর ওপর এমন হঠকারী বাণিজ্যে সরাসরি জরিপ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াও কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতা।
ওষুধের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে জনসাধারণের ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক জরিপ অনুযায়ী, চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশই এখন ওষুধের পেছনে খরচ হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর লাগামহীন দর বাড়ার কারণে নিম্ন আয়ের অনেকেই জরুরি প্রয়োজন না হলে ওষুধ কিনছে না।
১৯৮২ সালের ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের ১১ (১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, সরকার গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ওষুধের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। অথচ এই নিয়মের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। নিত্যপণ্য চাল, ডাল, মাছ, গোশত, পেঁয়াজ, তেল, ডিমের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদের আন্দোলন হচ্ছে। সভা-সেমিনারে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনার দাবি জানানো হচ্ছে। নিত্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে হৈচৈ, শোরগোল, তোলপাড় চলছে। কিন্তু পর্দার আড়ালেই নিত্যপণ্যের মতোই ওষুধের দাম হুহু করে বেড়ে গেছে।
অনেক পরিবারে চিকিৎসকের পরামর্শে কয়েক প্রকারের ওষুধ সেবন করতে হয়। কিন্তু অতিরিক্ত দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ফতুর হওয়ার জোগার হয়েছে। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে ওষুধের মতো অতিপ্রয়োজনীর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।
যে সব ওষুধের দাম বেড়েছে তা হলো: গ্যাস্ট্রিক ও আলসারে ফ্যামোম্যাক্স ২০ মিলিগ্রাম এক পাতার ১০টি ক্যাপসুল ২০ থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে, আর ফ্যামোম্যাক্স ৪০ মিলিগ্রাম ১০টির প্রতি পাতা ৩০ থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। আগে এক বক্সের দাম ছিল ৩০০ টাকায়, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫০০ টাকা। বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। গ্যাস্ট্রিকের প্রোগ্যাভি ২০০ এমএল সিরাপ ২৫০ থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ২০ শতাংশ। টার্বোক্লাভ ৫০০ এমজি প্লাস ১২৫ এমজি প্রতি পিস ক্যাপসুল ৫০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা হয়েছে।
এক পাতার ৪টির দাম ২০০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪০ টাকা। বেড়েছে ২০ শতাংশ। ফিক্সোলিন ২০০ মিলি গ্রাম ট্যাবলেট এক পাতার ১০টির দাম ৭০ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা এবং ফিক্সোলিন ৪০০ মিলি গ্রামের দাম প্রতি পাতা ১০০ থেকে ২০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১২০ টাকা। ট্রায়োসিম ২০০ মিলি গ্রামের এক পাতার ১০টির দাম ৩৫ টাকা থেকে ১০ বেড়ে ৪৫ টাকা হয়েছে।
ব্যথানাশক ক্যাপসুল রিলেনটাস ২ এমজি প্রতি পিস ৫ টাকা থেকে বেড়ে ৮ টাকা এবং ১০টির এক পাতা ৫০ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে। এই ওষুধের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ। ডায়াবেটিস রোগীদের ওষুধ নার্ভালিন ৭৫ মিলি গ্রামের এক পাতা ১০টি ক্যাপসুল ১৬০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২০০ টাকা। একই রোগের গ্লিপিটা ৫০ মি.গ্রাম ক্যাপসুল প্রতি পিস ১৩ থেকে বেড়ে ১৬ টাকা এবং প্রতি বক্স দাম ৩৯০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮০ টাকা হয়েছে। অর্থাত বেড়েছে ২৩ শতাংশ।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ওষুধ ট্রানেটা এম ২.৫ মি. প্রতি পিস ১২ টাকা থেকে বেড়ে ১৩ টাকা, হৃদরোগের জন্য ব্যবহৃত রসুটিন ১০ মিলিগ্রামের এক পাতার ১৫ টির দাম ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা, মেটাজিন এম আর এক পাতা ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে। গ্যাস্টিকের ক্যাপসুল অথেরা ৪০ মিলিগ্রাম এক পাতা ১০ টির দাম ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭০ টাকা। প্রতি পাতার দাম বেড়েছে ২০ টাকা। এক বক্সের দাম (৩০ টি) ৪৮৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫১০ টাকা। বেড়েছে ৫ শতাংশ।
নিওবিয়ন ভিটামিন বি-১ বি-৬ এবং বি ১২ প্রতি বক্স (৬০ টি) ৬৩৩ টাকা ৩৩ পয়সা থেকে দাম বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৭২০ টাকায়। ক্যালসিয়াম ফসিক্যাল-ডি ৫০০ মি.গ্রা.+২০০ আইইউ প্রতি ১০টির এক পাতা ১১০ টাকা থেকে বেড়ে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
২ মাসে আগে প্রতি পাতা ১০০ টাকায় বিক্রি হতো। গত জানুয়ারি তা ১০ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়। ক্যালসিয়াম ফসিক্যাল-ডিএক্স ৬০০ মি.গ্রা.+৪০০ মি.গ্রা আইইউ প্রতি বক্সের দাম ৪৪৮ টাকা থেকে বেড়ে ৫১০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। ফার্মেসির বিল দিতেই মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের ত্রাহিদশা দেশের ৬টি কোম্পানি উত্পাদিত ২৩৪টি ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে।
গত মার্চ মাসে দাম বাড়ানো হয়েছে বেশ কয়েকটি ওষুধের। সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট, ডায়াবেটিসের রোগীদের ইনসুলিন ও ইনজেকশনের দাম। এছাড়া হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, হাঁপানিসহ বিভিন্ন ওষুধ এবং ভিটামিনের দামও বেড়েছে। বাদ যায়নি জ্বর-সর্দির ট্যাবলেট-ক্যাপসুল, বিভিন্ন অসুখের সিরাপও। একদিকে দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে ওষুধের গুণগত মান কমছে। নকল ও ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব। তদারকির নামে চলছে অর্থ বাণিজ্য। সব দিক দিয়ে ঠকছে ক্রেতারা। দেশে ক্রেতা ঠকানোর দুঃসহ চিত্রও বিদ্যমান।
ক্যান্সারের ওষুধের দাম বিদেশের চেয়ে বেশি। এক বা একাধিক কোম্পানি ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদন করে। তবে দোকানদাররা বলেন, একটি কোম্পানির ওষুধ পাই। প্রচুর দাম। এ কারণে চোরাই পথে এটি আসছে। চোরাই পথে অনেক ওষুধ আছে, কারণ ডাক্তাররা লেখেন। বাংলাদেশের ওষুধে কাজ হয় না।
চোরাই পথের ওই ওষুধে দ্রুত কাজ করে। এ কারণে ডাক্তাররা লেখেন। আবার এক শ্রেণীর ডাক্তার উৎপাদিত অনেক কোম্পানির নিম্নমানের ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লেখেন, কারণ তারা নিয়মিত উপঢৌকন দেয়, ডলার পায়, গিফট পায়। বিদেশ সফরে যাওয়ার সুযোগ পায়। অনেকের গাড়ি কিনে দেয়। অনেকের বাসা ভাড়াও দেয়। বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং বিক্রি থেকে আয়ের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দাম বাড়ানোর হার অস্বাভাবিক। এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে কোম্পানিগুলো ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছে।
এ সময় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিও উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন ওষুধ কোম্পানিগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। তারা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে ওষুধের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কারণে ওষুধের দাম কিছুটা বাড়িয়ে সমন্বয় করা হয়েছে।
রাজধানীসহ সারাদেশের মাঠ পর্যায় ওষুধের দোকানদাররা বলেন, কোম্পানি প্রতি মাসে অধিকাংশ ওষুধের দাম বাড়ায়। সরকার বছরে একবার কিংবা দুইবার বাড়ায়। ক্রেতাদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় গিয়ে মার খাওয়ার উপক্রম।
যারা নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছে, তারা বাড়তি দাম দিতে গিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করেন। প্রতিদিনই ঝগড়া হয়। রাজধানীর মিটফোর্ট এলাকা ওষুধের বৃহত্তম মার্কেট। এটি মেড ইন জিনজিরা নামে পরিচিত। অর্থাৎ নকল ও ভেজাল ওষুধে ছড়াছড়ি। বিদেশী ওষুধও নকল বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক কোম্পানির ওষুধও নকল করে বিক্রি করছে। মাঠ পর্যায়ে ওষুধ প্রশাসনের এক শ্রেণীর এলাকাভিত্তিক পরিদর্শক প্রতি মাসে ওষুধের দোকান থেকে মাসোহারা নিয়ে থাকেন। সেই টাকার ভাগ উপর পর্যন্ত যায়। প্রতি মাসে টাকা কালেকশনে কোন অজুহাত দেখানো হয় না।
মাসে লাখ লাখ টাকা ইনকাম করছে ওই সকল পরিদর্শকরা। যে ওষুধে ৫০০ এমজি থাকার কথা, পরীক্ষাগারে ধরা পড়ে ২০০ কিংবা ২৫০ এমজি। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে দিয়েছে ৫০০ এমজি, কিন্তু আছে ২০০ এমজি। তাহলে রোগ প্রতিরোধে কাজ হবে না-এটাই স্বাভাবিক। রোগ না সারায় অনেক রোগী বারবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমিরেটস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা রোগীদের ওষুধ দেই। কিন্তু রোগীর কাজ হয় না। রোগী এসে বলে রোগ ভালো হয় না। তখন আবার ওষুধ চেঞ্জ করে দেই, তারপরও কাজ হয় না। এই বিষয়টিকে নজর দিতে হবে। কারণ ভেজাল ওষুধ ঢুকে গেছে বাজারে। চোরাই পথে আসছে ওষুধ। কোনটা আসল ও কোনটা নকল ওষুধ বোঝার উপায় নেই। জীবনরক্ষাকারী ওষুধ নকল হলে, রক্ষার পরিবর্তে ওষুধ জীবন কেড়ে নিচ্ছে।
অজ্ঞান করার ওষুধ হ্যালোথিন ইতিমধ্যে নকল প্রমাণিত হয়েছে। তাই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ নকল ও ভেজাল ওষুধে অঙ্গহানী হওয়ার আশংকা থাকে। লিভার, কিডনিসহ নানা শারীরিক সমস্যা হতে পারে। অসংক্রমক ব্যাধির সংখ্যা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধির অন্যতম কারণ নকল ও ভেজাল ওষুধ বলে চিকিৎসকরা অভিমত ব্যক্ত করেছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স এন্ড হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেন, যখন সরকারি হাসপাতালে ওষুধ কেনার জন্য টেন্ডার দেওয়া হয়, তখন ১৫০ টাকার ওষুধ ৭০ টাকায় সরবরাহ করে। যে ওষুধ বাজারে বিক্রি করছে ১৫০ টাকা। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে দিচ্ছে ৭০ টাকায়। তাহলে ওষুধে গুণগত মান ঠিক আছে? গুগগত মান নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। ওষুধের বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত।
বিদেশে ওষুধ ও খাদ্যে ভেজাল কোন অবস্থাতেই মেনে নেয় না। কঠোর হাতে দমন করা হয়। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু বাংলাদেশ চলে উল্টো। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মতে, দেশে ওষুধ কোম্পানি আছে ২৮৭টি। উৎপাদন করে প্রায় ২০০ কোম্পানি।
কিন্তু পরিচিত ২০টা কোম্পানি। বাকিরা কি ওষুধ তৈরি করে, কেউ জানে না। ঢাকার ওষুধের সাথে বিভাগীয় ও গ্রামের ওষুধের মিল নেই। গ্রামে অধিকাংশ ফার্মেসির নিবন্ধন নেই। সেখানে বেশি নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রি হয়। দেশে উৎপাদিত ওষুধগুলোর জেনেরিক নাম হলো ১৬৫০টা।
তবে কমার্শিয়াল নামে আছে ৩৬ হাজার। আবার বাংলাদেশের ওষুধ বিদেশে বিক্রি হয়। সেখানে সুনামের সাথে বিক্রি করে আসছে। কিন্তু ২০টা কোম্পানি ছাড়া বাকি কোম্পানিগুলোর ওষুধের অধিকাংশ নকল ও ভেজাল। কোম্পানির নামে নকল করে বিক্রি করে। এটা দেখার যেন কেউ নেই।
এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক সালাউদ্দিন বলেন, আমরা নিয়ন্ত্রণে যা যা দরকার তা করে যাচ্ছি। মূল্য নির্ধারণের কমিটি আছে। এর মধ্যে কমিটির মিটিং হয়নি। মাঠ পর্যায়ে যারা আছে তদারকি করে। নকল ও ভেজাল ওষুধ উদ্ধার অভিযান অব্যাহত আছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, নকল, ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ, নিবন্ধনহীন ওষুধ এবং সুরক্ষা সামগ্রীর ওপর এমন হঠকারী বাণিজ্যে সরাসরি জরিপ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াও কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতা।
ওষুধের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে জনসাধারণের ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক জরিপ অনুযায়ী, চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশই এখন ওষুধের পেছনে খরচ হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর লাগামহীন দর বাড়ার কারণে নিম্ন আয়ের অনেকেই জরুরি প্রয়োজন না হলে ওষুধ কিনছে না।
১৯৮২ সালের ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের ১১ (১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, সরকার গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ওষুধের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। অথচ এই নিয়মের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। নিত্যপণ্য চাল, ডাল, মাছ, গোশত, পেঁয়াজ, তেল, ডিমের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদের আন্দোলন হচ্ছে। সভা-সেমিনারে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনার দাবি জানানো হচ্ছে। নিত্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে হৈচৈ, শোরগোল, তোলপাড় চলছে। কিন্তু পর্দার আড়ালেই নিত্যপণ্যের মতোই ওষুধের দাম হুহু করে বেড়ে গেছে।
অনেক পরিবারে চিকিৎসকের পরামর্শে কয়েক প্রকারের ওষুধ সেবন করতে হয়। কিন্তু অতিরিক্ত দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ফতুর হওয়ার জোগার হয়েছে। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে ওষুধের মতো অতিপ্রয়োজনীর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।
যে সব ওষুধের দাম বেড়েছে তা হলো: গ্যাস্ট্রিক ও আলসারে ফ্যামোম্যাক্স ২০ মিলিগ্রাম এক পাতার ১০টি ক্যাপসুল ২০ থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে, আর ফ্যামোম্যাক্স ৪০ মিলিগ্রাম ১০টির প্রতি পাতা ৩০ থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। আগে এক বক্সের দাম ছিল ৩০০ টাকায়, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫০০ টাকা। বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। গ্যাস্ট্রিকের প্রোগ্যাভি ২০০ এমএল সিরাপ ২৫০ থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ২০ শতাংশ। টার্বোক্লাভ ৫০০ এমজি প্লাস ১২৫ এমজি প্রতি পিস ক্যাপসুল ৫০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা হয়েছে।
এক পাতার ৪টির দাম ২০০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪০ টাকা। বেড়েছে ২০ শতাংশ। ফিক্সোলিন ২০০ মিলি গ্রাম ট্যাবলেট এক পাতার ১০টির দাম ৭০ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা এবং ফিক্সোলিন ৪০০ মিলি গ্রামের দাম প্রতি পাতা ১০০ থেকে ২০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১২০ টাকা। ট্রায়োসিম ২০০ মিলি গ্রামের এক পাতার ১০টির দাম ৩৫ টাকা থেকে ১০ বেড়ে ৪৫ টাকা হয়েছে।
ব্যথানাশক ক্যাপসুল রিলেনটাস ২ এমজি প্রতি পিস ৫ টাকা থেকে বেড়ে ৮ টাকা এবং ১০টির এক পাতা ৫০ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে। এই ওষুধের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ। ডায়াবেটিস রোগীদের ওষুধ নার্ভালিন ৭৫ মিলি গ্রামের এক পাতা ১০টি ক্যাপসুল ১৬০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২০০ টাকা। একই রোগের গ্লিপিটা ৫০ মি.গ্রাম ক্যাপসুল প্রতি পিস ১৩ থেকে বেড়ে ১৬ টাকা এবং প্রতি বক্স দাম ৩৯০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮০ টাকা হয়েছে। অর্থাত বেড়েছে ২৩ শতাংশ।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ওষুধ ট্রানেটা এম ২.৫ মি. প্রতি পিস ১২ টাকা থেকে বেড়ে ১৩ টাকা, হৃদরোগের জন্য ব্যবহৃত রসুটিন ১০ মিলিগ্রামের এক পাতার ১৫ টির দাম ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা, মেটাজিন এম আর এক পাতা ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে। গ্যাস্টিকের ক্যাপসুল অথেরা ৪০ মিলিগ্রাম এক পাতা ১০ টির দাম ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭০ টাকা। প্রতি পাতার দাম বেড়েছে ২০ টাকা। এক বক্সের দাম (৩০ টি) ৪৮৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫১০ টাকা। বেড়েছে ৫ শতাংশ।
নিওবিয়ন ভিটামিন বি-১ বি-৬ এবং বি ১২ প্রতি বক্স (৬০ টি) ৬৩৩ টাকা ৩৩ পয়সা থেকে দাম বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৭২০ টাকায়। ক্যালসিয়াম ফসিক্যাল-ডি ৫০০ মি.গ্রা.+২০০ আইইউ প্রতি ১০টির এক পাতা ১১০ টাকা থেকে বেড়ে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
২ মাসে আগে প্রতি পাতা ১০০ টাকায় বিক্রি হতো। গত জানুয়ারি তা ১০ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়। ক্যালসিয়াম ফসিক্যাল-ডিএক্স ৬০০ মি.গ্রা.+৪০০ মি.গ্রা আইইউ প্রতি বক্সের দাম ৪৪৮ টাকা থেকে বেড়ে ৫১০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। ফার্মেসির বিল দিতেই মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের ত্রাহিদশা দেশের ৬টি কোম্পানি উত্পাদিত ২৩৪টি ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে।